আল–জাজিরা এক্সপ্লেইনার ট্রাম্প কেন ভারতের বেলায় গরম, চীনের বেলায় নরম

prothomalo-bangla_2025-08-21_ha4eveb5_Capture.avif
আনোয়ার হোসেন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন। সেই সঙ্গে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল যেসব দেশ কিনছে, তাদের ওপরও ‘পরেোাক্ষ নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করা হতে পারে। লক্ষ্য একটাই—রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানা।

আগস্ট মাসের শুরুতে ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। বলেছেন, রাশিয়ার তেলের কেনার শাস্তি হিসেবে ভারতের পণ্যে এই অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে মোট শুল্কহার দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। চীনের বিরুদ্ধে একই ধরনের পদক্ষেপ নেননি ট্রাম্প, যদিও চীন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জ্বালানি ক্রেতা।

চীনা কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর রাশিয়া থেকে রেকর্ড ১০৯ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ৯০ লাখ টন তেল আমদানি করেছে চীন। দেশটির মোট জ্বালানি আমদানির যা প্রায় ২০ শতাংশ। অন্যদিকে ভারত ২০২৪ সালে আমদানি করেছে ৮৮ মিলিয়ন বা ৮ কোটি ৮০ লাখ টন। অনেকের মতে, রাশিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক ভরসা এখন চীন, যে কারণে মস্কোর পক্ষে যুদ্ধ চালানো সম্ভব হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দল ‘স্যানকশনিং রাশিয়া অ্যাক্ট ২০২৫’ নামে একটি বিল প্রস্তাব করেছে। বিলটি পাস হলে যেসব দেশ রাশিয়ার তেল ও গ্যাস আমদানি অব্যাহত রেখেছে বলে ধারণা করা হবে, তাদের পণ্যে ট্রাম্প ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের ক্ষমতা পাবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটররা এখন ট্রাম্পের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছেন। পেলেই তাঁরা বিলটি পেশ করবেন।

১৫ আগস্ট ফক্স নিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়, চীনের ওপরও কি একই শাস্তি আসছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনই ভাবছেন না—হয়তো দু-তিন সপ্তাহ পরে ভাবতে হবে। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প মূলত সময় নিচ্ছেন। লক্ষ্য হলো, বিরল খনিজ নিয়ে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির সম্ভাবনা খোলা রাখা।

১৭টি মৌলিক উপাদানকে একত্রে বিরল খনিজ বলা হয়। গাড়ির যন্ত্রাংশ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সামরিক প্রযুক্তিসহ অসংখ্য শিল্পের জন্য এই খনিজ অপরিহার্য। চীন অনেক বছর ধরেই এসব খনিজ উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে আধিপত্য বিস্তার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বহু শিল্প চীনা খনিজের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় বাণিজ্য আলোচনার কেন্দ্রে আছে এই খনিজ।

চীনের প্রতি ট্রাম্পের তুলনামূলক নরম হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হিসাবও আছে। ডিসেম্বরের ক্রিসমাস মৌসুমের আগে মার্কিন খুচরা ব্যবসায়ীরা ব্যাপক হারে চীনা পণ্য আমদানি করছেন। এখন শুল্ক বাড়ালে দামও বাড়বে। এ ছাড়া ট্রাম্প সম্প্রতি চীনের দাবির মুখে সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানিতে কিছুটা শিথিলতা এনেছেন এবং এনভিডিয়াকে উন্নত চিপ বিক্রির অনুমতি দিয়েছেন।

মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেছেন, যুদ্ধের আগে চীনের মোট জ্বালানি আমদানির ১৩ শতাংশ ছিল রাশিয়ার তেল, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ শতাংশ। কিন্তু যুদ্ধের আগে ভারতের আমদানি ছিল ১ শতাংশের কম, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে। তাঁর অভিযোগ, ভারত সস্তা রুশ তেল কিনে প্রক্রিয়াজাত করে পুনরায় বিক্রি করছে। তিনি একে বলেছেন আর্বিট্রাজ; অর্থাৎ দুই বাজারের দামের ব্যবধান কাজে লাগানো। এই প্রক্রিয়ায় ভারতীয় কোম্পানিগুলো ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার মুনাফা করেছে—ভারতের সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে কয়েকটি পরিবার এই মুনাফা করেছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের আরও কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ভারতের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছেন। হোয়াইট হাউসের উপপ্রধান স্টিফেন মিলার ভারতের এই রাশিয়ার তেল কেনার নীতিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারোও অভিযোগ করেছেন, ভারত কার্যত রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থায়নে সহায়তা করছে।

ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন কি না, সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স। তাঁর মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আরও অনেক কিছুর সঙ্গে তা জড়িত। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সতর্ক করেছেন, চীনের পণ্যে পরোক্ষ শুল্ক আরোপ করা হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে।

অন্যদিকে ওয়াশিংটনের চীনা দূতাবাস জানিয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের বাণিজ্য আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বৈধ। দূতাবাসের মুখপাত্র লিউ পেংইউ বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইনসিদ্ধ কাঠামোর মধ্যে থেকেই চীন রাশিয়াকে সহযোগিতা করছে।

চীনের অর্থনীতির চাপ

ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি হলে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হবে এবং চীনের অর্থনীতির জন্য তা সুফল বয়ে আনবে। জুলাই মাসে দেশটির কারখানা উৎপাদন, বিনিয়োগ ও খুচরা বিক্রি কমেছে। তরুণদের বেকারত্বও বেড়েছে—জুলাই মাসে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী শহুরে যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশে; গত ১১ মাসের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।

হংকংভিত্তিক ন্যাটিক্সিস ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া হেরেরো বলেছেন, চীনের অর্থনীতিতে চিড় দেখা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘চীন অনেক দিন ধরেই পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞার ভয় মাথায় রেখে বিকল্প বাণিজ্যপথ তৈরি করছে। সে জন্য তাদের অর্থনীতি সহজে চেপে ধরা যাবে না।’ তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও এটি ঝুঁকি, কেননা, চীনা আমদানি বেশি হওয়ায় শুল্ক বাড়লে মার্কিন ভোক্তাদের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে।

গত বছর চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি ছিল ২৯৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ২৯ হাজার ৫৪০ কোটি  ডলার; আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। তবে এপ্রিলে শুল্কযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর ১৪৫ শতাংশ এবং চীন পাল্টা ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এতে কার্যত দুই দেশের বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
মার্কিন সেনসাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ শুল্কের কারণে চলতি বছরের জুন মাসে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি ২০০৪ সালের পর সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। মার্চ থেকে আগস্টের মধ্যে এ ঘাটতি কমেছে ২২ দশমিক ২ বিলিয়ন বা ২ হাজার ২২০ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা প্রায় ৭০ শতাংশ কম।

শুল্কযুদ্ধের বিরতি

গত মে মাসে জেনেভায় আলোচনার পর দুই দেশ শুল্ক কমায়—মার্কিন শুল্ক ৩০ শতাংশে এবং চীনের শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। চীন বিরল খনিজ রপ্তানিও আংশিকভাবে শুরু করে। পরে ১২ আগস্ট দুই দেশ নতুন করে ৯০ দিনের জন্য শুল্কবিরতি ঘোষণা করে। ফলে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত নতুন শুল্ক আরোপিত হবে না।

অর্থনীতিবিদ হেরেরোর মতে, বড় কোনো নাটকীয় কিছু না ঘটলেও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তি হবে। তাঁর ভাষায়, ‘দুই দেশই কিছু ইতিবাচক খবর চাইছে, নইলে তারা উভয়েই ধাক্কা খাবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top