ধ্বংসের পথে পাঁচ শতাধিক শিল্প কারখানা

karkhana.webp
আনোয়ার হোসেন
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তহীনতায় গত  এক বছরে পাঁচ শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও রুগ্ণ হয়েছে। ব্যাংকগুলো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃ তফসিল করতে সম্মত হয়ে গভর্নরের সিদ্ধান্তের জন্য চিঠি পাঠিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের গড়িমসিতে শিল্প উদ্যোক্তারা কোনো সহযোগিতা পাননি। বরং অনেক ক্ষেত্রে অসহযোগিতা পেয়েছেন। অনেক ব্যবসায়ী গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেও কোনো ফল পাননি। এ অবস্থায় ধ্বংসের পথে রয়েছে পাঁচ শতাধিক শিল্প-কারখানা।

অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে খেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃ তফসিল প্রক্রিয়ায় ধীরগতির কারণে দেশের বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান পুঁজি সংকটে পড়ে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। নগদ অর্থের অভাবে অনেক কারখানা ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে, আবার অনেক প্রতিষ্ঠান অনিশ্চয়তায় ভুগছে। ফলে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আর সরাসরি ঋণ পুনঃ তফসিলের আবেদন অনুমোদন বা বাতিল করে না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকেই এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত বড় ঋণগ্রহীতাদের সহায়তায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ উদ্যোগ নেয়।

গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন প্রস্তাব যাচাইয়ের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৩০০টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। যাদের বেশির ভাগ রপ্তানিনির্ভর খাত। যেমন- টেক্সটাইল, তৈরি পোশাক ও চামড়াজাত শিল্প। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ২৮০টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, আবেদন নিষ্পত্তির ধীরগতিতে তাদের নগদ অর্থের প্রবাহ কমে গেছে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, কর্মী ছাঁটাই বাড়ছে এবং সরবরাহকারীদের কাছে বকেয়া জমছে। ফলে অর্থনীতির উৎপাদনশীল ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন-বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘সব আবেদন একটি মাত্র কমিটি দেখছে বলে প্রক্রিয়া ধীরগতির শিকার হয়েছে। প্রতিটি বৈঠকে মাত্র তিন থেকে চারটি আবেদন নিষ্পত্তি হচ্ছে। এই হারে চললে সব আবেদন নিষ্পত্তি করতে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।’

বিজিএমইএ গত ১০ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে অতিরিক্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা প্রক্রিয়ায় অংশীজনদের অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।

সাউথ এশীয় নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে। দীর্ঘসূত্রতার কারণে বহু ব্যবসা কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হতে পারে।’ তিনি মনে করেন, অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রকৃত ঋণগ্রহীতাদের সময়মতো সহায়তা দেওয়া জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অতীতে ঋণ পুনঃ তফসিল অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে অনুমোদিত হয়েছিল। এর ফলে বর্তমান সংকটে প্রকৃত ঋণগ্রহীতারা অসুবিধায় পড়েছেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্যই কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিপুল আবেদন ও জটিলতা থাকায় সময় লাগছে। তবে প্রক্রিয়া দ্রুত করার চেষ্টা চলছে এবং যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো শিগগিরই সমাধান পাবে।’ কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, শিল্প পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এক বছরে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ৫ শতাধিক কারখানা বন্ধ ও রুগ্ণ হয়েছে। বন্ধ কারখাআর ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ শ্রমিক বেকার হয়েছেন। তাঁদের অনেকে চাকরির জন্য ছুটতে ছুটতে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে গ্রামে ফিরেছেন। বন্ধ কারখানার বেশির ভাগই তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার ও টেক্সটাইলশিল্পের। শিল্প মালিকরা বলছেন, ঋণ পুনঃ তফসিলে ধীরগতি পাশাপাশি উচ্চসুদ, কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার ছাড়াও কাঁচামাল আমদানিতে এলসি সমস্যা, শিল্পে অব্যাহত গ্যাস সংকট, দফায় দফায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাওয়া, অব্যাহতভাবে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচে অনেকে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। তাঁরা চরম সংকটের কারণেই কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনিয়ন্ত্রিত এ পরিস্থিতিতে খেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃ তফসিল প্রক্রিয়ায় ধীরগতির কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে অস্বাভাবিক গতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। যা ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর দেওয়া প্রতি চার টাকার মধ্যে এক টাকারও বেশি এখন খেলাপি হয়ে গেছে।

এর আগে চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। তখন খেলাপি ঋণের হার ছিল ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

এ ছাড়া ২০২৪ সালের জুনে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এই অঙ্ক বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top