প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, তুলনামূলক স্বচ্ছ ও উন্নত কর্মপরিবেশের কারণেই অনেকে বেসরকারী সংস্থায় ক্যারিয়ার গড়েন
বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অনেকেই উন্নয়ন সংস্থা বা ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনে চাকরি করতে আগ্রহী। এ খাতে ক্যারিয়ার গড়েছেন—এ রকম বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু বেতন বা আর্থিক স্থিতিশীলতা নয়, বরং সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সুযোগ রয়েছে এই পেশায়। মানুষের জীবন স্পর্শ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, আর তুলনামূলক স্বচ্ছ ও উন্নত কর্মপরিবেশ—এসব কারণেই তরুণেরা এই খাতের প্রতি ঝুঁকছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থায় যুক্ত ছিলেন ফারিয়া আক্তার সোমা। তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় ভেবেছি, চাকরি মানেই শুধু আয়রোজগার নয়; এর সঙ্গে যেন মানুষের জীবনে কিছু বদল আনার সুযোগ থাকে। সেই জায়গা থেকে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) কাজটা আমি উপভোগ করেছি।’
ফারিয়ার মতো অনেকের কাছে এই খাত মানে শুধু একটি চাকরি নয়, বরং একটি দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতি—যেখানে কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে নীতি প্রণয়ন, প্রকল্প বাস্তবায়ন, মাঠপর্যায়ের সমন্বয় এবং জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ।
কেন উন্নয়ন সংস্থা
বাংলাদেশে এনজিও খাত গত কয়েক দশকে বিস্তৃত হয়েছে। ছোট থেকে বড়, স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক—প্রতিটি সংস্থা মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই খাতের বিশেষত্ব হলো, এটি সরাসরি মানবকল্যাণের সঙ্গে যুক্ত, যা অন্যান্য বাণিজ্যিক খাতের চাকরিতে পাওয়া যায় না। তরুণ প্রজন্মের কাছে উন্নয়ন খাতের চাকরি মানে এখন আর শুধু ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা’ নয়। বরং এটি হয়ে উঠেছে ক্যারিয়ার গড়ার একটি শক্তিশালী ক্ষেত্র। এখানে রয়েছে দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ, নানা প্রশিক্ষণ, বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা, এমনকি উচ্চশিক্ষার সঙ্গেও যুক্ত হওয়ার পথ।
আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলো ইউনিসেফ, ইউএনডিপি, রেড ক্রস, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল কিংবা ওয়ার্ল্ড ভিশন—তাদের কর্মীদের জন্য নিয়মিত আয়োজন করে প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও মেন্টরশিপ। ফলে একজন তরুণ কর্মী কেবল নিজের দায়িত্ব পালন করেন না; বরং তিনি হয়ে ওঠেন আরও প্রস্তুত, আরও আত্মবিশ্বাসী, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) অধ্যাপক রিদওয়ানুল হক মনে করেন, উন্নয়ন খাতে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক সামাজিক ও ব্যবসায়িক নীতি নিয়ে ধৈর্য ধরে পড়াশোনা করার মানসিকতা থাকতে হবে। শুধু তা–ই নয়, নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক আবহ বুঝতে পারা এবং সেই প্রেক্ষিত অনুযায়ী কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল তৈরি করা যায়—সে বিষয়েও তাঁদের আগ্রহ থাকা প্রয়োজন। উন্নয়ন সংস্থায় ভালো করতে চাইলে সমাজ উন্নয়নের প্রতি গভীর আবেগ ও দায়বদ্ধতা থাকতে হবে।
শুরু করবেন কীভাবে—
বেসরকারি সংস্থায় ক্যারিয়ার গড়ার জন্য শুরুতে অনেকেই প্রাথমিক অবস্থা থেকে শুরু করে। যেমন প্রজেক্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট, ফিল্ড অফিসার, রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটসহ অনেক পদে। এ পর্যায়ে মূল লক্ষ্য হলো মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা অর্জন এবং প্রকল্প পরিচালনার প্রাথমিক দক্ষতা তৈরি।
তানভীর তুষার একটি উন্নয়ন সংস্থার মেন্টর হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি শুরুতে বেশ কিছু সামাজিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করেছি। এখন একদম মাঠপর্যায়ে আরবান স্লাম এরিয়াগুলোতে নিয়মিত যাচ্ছি। মানুষদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করা এক অদ্ভুত অনুভূতি, নিজেকে তাদের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি।’
বেসরকারি সংস্থাগুলোতে ধাপে ধাপে কাজের পরিধি বৃদ্ধি পায়। একজন প্রজেক্ট অফিসার হতে পারেন প্রোগ্রাম ম্যানেজার, এরপর টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার বা কান্ট্রি ডিরেক্টর পর্যন্ত। তবে এই অগ্রগতি নির্ভর করে কর্মক্ষমতা, দক্ষতা এবং নেটওয়ার্কিংসহ আরও কিছু যোগ্যতার ওপর।
প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও যোগ্যতা—
বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতে হলে শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা নয়, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষাগত যোগ্যতা—
• সাধারণত সামাজিক বিজ্ঞান, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, পাবলিক হেলথ, পরিবেশবিজ্ঞান, অর্থনীতি বা মানবিক বিষয়।
• উচ্চশিক্ষা (মাস্টার্স বা সমতুল্য) বড় সংস্থায় দরকার হয়, বিশেষ করে টেকনিক্যাল বা ম্যানেজারিয়াল পদে।
প্রযুক্তিগত দক্ষতা—
• প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট (PMD Pro, Prince2)
• মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন (M&E)
• বাজেট পরিকল্পনা ও রিপোর্ট লেখা
• ডেটা বিশ্লেষণ (AI, Excel, SPSS, STATA, Power BI)
সফট স্কিল—
• যোগাযোগ ও নেটওয়ার্কিং
• বহু সাংস্কৃতিক পরিবেশে দল পরিচালনা
• সমাধানমুখী মনোভাব ও সমন্বয় ক্ষমতা
• ভাষা ও আন্তর্জাতিক যোগ্যতা
• ইংরেজি অপরিহার্য; কখনো কখনো ফরাসি, স্প্যানিশ।
• আন্তর্জাতিক প্রকল্পে কাজের অভিজ্ঞতা হলে অগ্রাধিকার।
চ্যালেঞ্জও আছে—
এই খাতের বড় চ্যালেঞ্জ হলো চাকরির স্থায়িত্ব। অনেক প্রকল্প নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য হয়, তাই পদোন্নতি বা চাকরির নিশ্চয়তা প্রজেক্টের স্থায়িত্বের ওপর নির্ভর করে। সামাজিক ও প্রাকৃতিক ঝুঁকিও বড় চ্যালেঞ্জ। মাঠকর্মীরা গ্রামীণ বা দুর্গম এলাকায় গিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়, বিশেষ করে বন্যা, ঝড় বা মহামারি পরিস্থিতিতে কাজ করা মানসিক ও শারীরিক চাপ বাড়ায়।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ—
বাংলাদেশের উন্নয়ন খাত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা—এসব ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে উন্নয়ন সংস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষা ও কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সবচেয়ে বেশি। তরুণদের উচিত জলবায়ু,শিক্ষা ও কৃষিসম্পর্কিত বৈশ্বিক নীতি, প্রেক্ষাপট ও কৌশলগত পরিকল্পনা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে ধৈর্য ও আন্তরিকতার সঙ্গে এসব খাতে যুক্ত হওয়া। এতে তাঁরা তাঁদের ক্যারিয়ারে দীর্ঘ মেয়াদে সফল হতে পারবেন।