‘সিলিন্ডারের গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ায় রাতে বাসায় রান্না করতে পারিনি। তাই হোটেলে রাতের খাবার খেতে বের হয়েছিলাম। যখন বের হই, তখন রাত ১০টা ৪০ মিনিট। রাত ১১টা ১৫ মিনিটে ফিরে এসে দেখি গেট (ফটক) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দারোয়ান কিছুতেই আমাকে ভবনে ঢুকতে দিতে চাচ্ছিলেন না। ভাত খেতে গিয়েছি, এ কথা বারবার বলার পরও গেট খোলেননি দারোয়ান।’
এ কথা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীর। ভাড়া বাসার দারোয়ান তাঁকে মারধর করেছেন—এমন খবরে সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর থেকে ওই দারোয়ান পলাতক। তবে দারোয়ানের দাবি, তিনি ওই ছাত্রীকে মারেননি। রাতে দেরি করে বাসায় ফেরা নিয়ে প্রশ্ন করায় ওই ছাত্রী তাঁকে থাপ্পড় দিয়েছেন।
যে ভবনে এসব ঘটনা ঘটে, সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রী গত মাসেই ওই ভবনটিতে ওঠেন। পাঁচতলা ভবনটির তিনতলার ফ্ল্যাটে আরও তিন সহপাঠীসহ থাকতেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর দুই মাস আগে তাঁর ক্লাস শুরু হয়েছে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওই ছাত্রী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বাসায় ফিরে ফটক বন্ধ দেখে তিনি দারোয়ানকে ডাকতে শুরু করেন। রাত ১১টা ২২ মিনিট পর্যন্ত নিচুস্বরে ডেকেছেন। এরপর জোরে ডাক দেওয়া শুরু করেন তিনি। এ সময় দারোয়ান ভবনের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করলেও ফটক খুলছিলেন না। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে তিনি বাসায় থাকা তাঁর সহপাঠীদের একজনকে ফোন দেন। ওই সহপাঠী নিচে নামার পর দারোয়ান তাঁর সঙ্গেও তর্ক শুরু করে দেন।
সহপাঠীকেও দারোয়ান ফটক খুলতে দিচ্ছিলেন না জানিয়ে ওই ছাত্রী বলেন, ‘আমার রুমমেট নিচে নামার পর দারোয়ান তাঁকে বলেন, ওই মেয়েকে ঢুকতে দেব না, “ওরে বলো আজকে বাইরে থাকতে।” রুমমেট তখন দারোয়ানকে বলেন, “মেয়ে মানুষ, এত রাতে কোথায় যাবে।” তখন দারোয়ান জবাব দেন, “যেখানে খুশি সেখানে যাক।”’
সহপাঠীকেও দারোয়ান ফটক খুলতে দিচ্ছিলেন না জানিয়ে ওই ছাত্রী বলেন, ‘আমার রুমমেট নিচে নামার পর দারোয়ান তাঁকে বলেন, “ওই মেয়েকে ঢুকতে দেব না, ওরে বলো আজকে বাইরে থাকতে।” রুমমেট তখন দারোয়ানকে বলেন, “মেয়ে মানুষ, এত রাতে কোথায় যাবে।” তখন দারোয়ান জবাব দেন, “যেখানে খুশি সেখানে যাক।”’
দারোয়ানের সঙ্গে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে সহপাঠীর সহায়তায় অনেকটা জোর করে ভবনে ঢোকেন বলে জানান ওই ছাত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাকে ঢুকতে না দিতে দারোয়ান গেটের দরজা চাপ দিয়ে ধরে রেখেছিলেন। এতে শরীরে আঘাত লাগায় আমি প্রতিবাদ করি। একই সঙ্গে কেন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না, সেটি জানতে চাইতেই দারোয়ান আমার গালে থাপ্পড় দেন, বুকে ঘুষিও দিয়েছেন।’
ওই ছাত্রী আরও বলেন, ‘দারোয়ান আমাকে মারার পর আমিও রাগে দারোয়ানের দিকে তেড়ে যাই। এ সময় দারোয়ান আমাকে পেটে লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দেন। এ সময় স্থানীয় কয়েকজন মুরব্বি দারোয়ানের বিচার করবেন বলে আশ্বাস দেন। এরপর আমি রুমে চলে যাই। তখন রাত ১২টা ৪০ বাজে।’
ওই ছাত্রী কক্ষে ফিরে গেলেও হইচই শুনে এরই মধ্যে আশপাশের ভবন থেকে অনেক শিক্ষার্থী জড়ো হন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে দারোয়ানকে খুঁজছিলেন। এ সময় দারোয়ান পালিয়ে পাশে গ্রামের ভেতরে চলে যান। শিক্ষার্থীদের একজন তাঁকে ধরতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছেন। এ কারণে শিক্ষার্থীরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তবে হঠাৎ মাইকে ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়। এতে অনেকেই আহত হয়েছেন।’
ওই ছাত্রী আরও বলেন, ‘ভবনটির বিভিন্ন ফ্ল্যাটে আমরা অনেক ছাত্রী থাকি। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সময় আমরা প্রত্যেকেই ছাদ থেকে এই ঘটনা দেখেছি। চিৎকার করে মানুষের সাহায্য চেয়েছি। খুব আতঙ্কিত ছিলাম। তাই ভোরেই কিছু কাপড় সঙ্গে নিয়ে বাসাটি ছেড়েছিলাম। তবে গত বৃহস্পতিবার অন্য এক ছাত্রীর সঙ্গে বাসায় ফিরেছি।’
সংঘর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়ের করা মামলায় বাসার ওই দারোয়ানের নাম না দেখে হতাশা প্রকাশ করেন ওই ছাত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি দারোয়ানের বিচার চাই। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিচার চাই। একজন ছাত্রীর কি রাতে জরুরি কোনো কাজ থাকতে পারে না? আমাকে নিয়ে নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আমি চাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সত্যিটা খুঁজে বের করুক।’
গত ৩০ আগস্ট দিবাগত রাত সোয়া ১২টা থেকে পরদিন রোববার দুপুর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কয়েক দফা সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন, প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ এবং অন্তত ২০০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় ১০ থেকে ১২ জন স্থানীয় বাসিন্দাও আহত হন।