বাংলাদেশে যা বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস), ভারতে তা ইউপিএসসি (ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন)। ভারতেও পাবলিক সার্ভিসে প্রকৌশলী (ইঞ্জিনিয়ার), চিকিৎসাবিদ্যাসহ টেকনিক্যাল বিষয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও সাফল্য বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে নানা আলোচনা আছে। এই পরিবর্তন ভারতের আমলাতন্ত্রে সহানুভূতি ও বৈচিত্র্যময় দৃষ্টিভঙ্গি হারানোর আশঙ্কা তৈরি করেছে। ভারতের পার্লামেন্টের সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে দেশটির গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পাঠকের জন্য এ প্রতিবেদনের মূল অংশ তুলে ধরা হলো।
ভারতের সিভিল সার্ভিসের একসময়ের মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হতো মানবিক বিভাগের স্নাতকদের বা আসলে তাঁরাই চাকরি পেতেন বা চাকরি করতেন বেশি। এখন আর সে অবস্থা নেই। প্রকৌশল ও টেকনিক্যাল বিষয়ের শিক্ষার্থীরা সেই জায়গায় চলে আসছেন। ১৯৮০ ও ৯০–এর দশকে ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের ইউপিএসসির বিভিন্ন পদে প্রাধান্য ছিল। আজকের দিনে এসে সেই চিত্র বদলে গেছে। এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থী টেকনিক্যাল অর্থাৎ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে আসছেন, যেখানে সফল প্রার্থীদের প্রায় দুই–তৃতীয়াংশই প্রকৌশলী।
ভারতের পার্লামেন্টারি কমিটির এক প্রতিবেদনে এ চিত্র ধরা পড়েছে। দেশটির সিভিল সার্ভিসের এই ভারসাম্যহীনতাকে তুলে ধরে সতর্ক করে দিয়েছে যে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় দেশের আমলাতন্ত্র হারাচ্ছে বৈচিত্র্য এবং একই সঙ্গে শাসনকার্যে প্রয়োজনীয় সহানুভূতি ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
ভারত সরকারের ইউপিএসসি–সংক্রান্ত ২০২৩ সালের এই প্রতিবেদনে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় টেকনিক্যাল বিভাগের প্রার্থীদের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সফল প্রার্থীদের মধ্যে ২০১১ সালে ৪৬ শতাংশ প্রকৌশলী ছিলেন, যা বেড়ে ২০২০ সালে দাঁড়ায় ৬৫ শতাংশে। একই সময়ে মেডিকেল শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ শতাংশ থেকে নেমে আসে মাত্র ৪ শতাংশে। মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানের সংখ্যা ২৩–২৮ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করলেও ২০১১ সালের ২৭ শতাংশ থেকে ২০২০ সালে কমে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে, যা প্রকৌশলীদের প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগ।
প্রকৌশলী ও চিকিৎসা পেশা (চিকিৎসাসংক্রান্ত নানা পেশা) মিলিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ৭০ শতাংশের বেশি প্রার্থী আসছেন টেকনিক্যাল ধারার শিক্ষাব্যবস্থা থেকে। এতে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে দেশ হয়তো ‘অসাধারণ চিকিৎসক ও প্রকৌশলী’ হারাতে যাচ্ছে।।

সংখ্যার বাইরের অন্তর্দৃষ্টি: ঐতিহাসিক পটভূমি ও প্রবণতা
ঐতিহাসিক পরিবর্তন: ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আইএএস নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীদের শিক্ষাগত পটভূমিতে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এ প্রবণতার বিপরীত চিত্র দেখা যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং, চিকিৎসাবিদ্যা ও কম্পিউটারবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোর শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসতে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও চিকিৎসা–সংশ্লিষ্ট বিদ্যা শীর্ষে চলে আসে। এ সময়ে দেশটির অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়েন।
কেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী অধিক সফল
১. Problem-Solving ও Aptitude Test-এর সঙ্গে পরিচিতি—
২০১১ সালে সিভিল সার্ভিস অ্যাপটিচিউড টেস্ট (Civil Services Aptitude Test–CSAT) চালুর পর পরীক্ষার ধরন পাল্টে যায়। এতে যুক্তি–তর্ক, গণিত ও বিশ্লেষণক্ষমতা যাচাই করা হয়, যেখানে প্রকৌশলীদের প্রাকৃতিক দক্ষতা আছে। পরীক্ষাপদ্ধতি বদলে যাওয়ার পরে হিউম্যানিটিজ প্রার্থীদের সাফল্যের হার ২০০৯ সালের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ থেকে নেমে ২০১২ সালে ১৫ শতাংশে দাঁড়ায়, আর ইঞ্জিনিয়ারিং প্রার্থীদের সাফল্য বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫০ শতাংশে।
২. Optional Subjects-এ বহুমুখিতা
অনেক প্রকৌশলী ইউপিএসসিতে টেকনিক্যাল বিষয় বেছে নেন না; বরং রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান বা ভূগোলের মতো হিউম্যানিটিজ বিষয় বেছে নেন, যেগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি নম্বর পেতে সুযোগ দেয় এবং যেখানে প্রস্তুতির জন্য প্রচুর রিসোর্স মেলে। বিশ্লেষণাত্মক প্রশিক্ষণের কারণে প্রকৌশলীরা এসব নতুন বিষয় দ্রুত আয়ত্ত করতে পারেন।
কেন ইঞ্জিনিয়ার বা প্রকৌশলীরা নিজের ক্ষেত্র ছাড়ছেন
দীর্ঘদিন ধরে ভারতে সিভিল সার্ভিসকে সাফল্যের চূড়ান্ত প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। পরিবার ও সমাজ মেধাবী শিক্ষার্থীদের, বিশেষত প্রকৌশলীদের ব্যক্তিগত চাকরির বাইরে আরও ‘উচ্চতর লক্ষ্য’–এর দিকে ঠেলে দেয়। এভাবেই অনেক টেকনিক্যাল মেধা জনসেবায় প্রবাহিত হয়। এ ছাড়া প্রভাব ও ক্ষমতার আশা, চাকরির নিরাপত্তা ও মর্যাদা এবং মূল খাতে সীমিত সুযোগের কারণে অনেকেই নিজ ক্ষেত্র ছেড়ে সিভিল সার্ভিসের দিকে ঝুঁকছেন।
দুশ্চিন্তার কারণ আসলে কী
১. বৈচিত্র্য হারাচ্ছে
হিউম্যানিটিজ স্নাতকেরা সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি, সহানুভূতি ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণক্ষমতা নিয়ে আসেন, যা জনপ্রশাসনে অত্যন্ত জরুরি।
২. খাতভিত্তিক ঘাটতি
কমিটি আক্ষেপ করেছে যে সিভিল সার্ভিসের প্রতি ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ স্বাস্থ্যসেবা ও প্রকৌশল খাতকে হয়তো উচ্চমানের পেশাজীবী থেকে বঞ্চিত করছে।
৩. সিদ্ধান্ত গ্রহণে বৈচিত্র্য
এর ফলে অতিরিক্ত টেকনিক্যাল আমলাতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে ভারত। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব করতে না পারার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে দেশটিতে।
সংসদীয় কমিটির সতর্কবার্তা শুধু পরিসংখ্যানগত তথ্য নয়, এটি মনে করিয়ে দেয় যে ভারতের আমলাতন্ত্রে দেশের সামাজিক বৈচিত্র্যের প্রতিফলন থাকা আবশ্যক। প্রযুক্তিনির্ভর আমলাতন্ত্র কার্যকারিতা দিতে পারে বটে, কিন্তু তাতে হারিয়ে যেতে পারে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি; ঠিক এখানেই মানবিক কিংবা সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।
আন্তর্জাতিক পটভূমি
বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে, বিশেষ করে ইউরোপ বা চীনের মতো সফল দেশগুলোয় সিভিল সার্ভেন্ট তৈরিতে সমাজবিজ্ঞান ও লিবারেল আর্টস গুরুত্ব পায়। কারণ, তাঁরা নীতি নিয়ে প্রশ্ন করতে, পটভূমি ব্যাখ্যা করতে ও জনসাধারণের সঙ্গে নীতির সংযোগ ঘটাতে সক্ষম হন। ভারতের ক্ষেত্রেও একই পুনঃ সামঞ্জস্য প্রয়োজন, যাতে আগামী দিনের প্রশাসকেরা কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষ সমস্যার সমাধানকারী না হয়ে সামাজিক বুনন বোঝা সহানুভূতিশীল সিভিল সার্ভেন্ট হয়ে উঠতে পারেন। কারণ, শাসনব্যবস্থা শুধু কার্যকারিতার বিষয় নয়, এটি সমতার ও দূরদর্শিতারও বিষয়।
প্রস্তাবিত সংস্কার
১. CSAT–এর কাঠামো পুনর্বিবেচনা করে টেকনিক্যাল পক্ষপাত কমানো।
২. ডোমেইন এক্সপার্টদের জন্য পৃথক সার্ভিস ট্র্যাক তৈরি করা।
৩. বিভিন্ন শিক্ষাপ্রবাহ থেকে সমন্বিত নিয়োগ উৎসাহিত করা।
এই সমাধান হয়তো প্রকৌশলীদের জনসেবায় নিরুৎসাহিত করা নয়; বরং সিস্টেমকে পুনঃ সামঞ্জস্য করা, পরীক্ষার কাঠামোয় সংস্কার আনা এবং বিভিন্ন শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ভারতের সিভিল সার্ভিসে প্রকৌশলীদের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য নিঃসন্দেহে প্রশাসনকে আরও বিশ্লেষণমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, বৈচিত্র্যপূর্ণ মতামত ও আন্তবিষয়ক সমন্বয়কে দুর্বল করছে, যা কার্যকর প্রশাসনের জন্য অপরিহার্য। তাহলে ভারতের আমলাতন্ত্র একদিকে যেমন প্রযুক্তিগত দক্ষতায় সমৃদ্ধ হবে, অন্যদিকে সামাজিক ন্যায়, সমতা ও মানবিকতার দিক থেকেও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।