মবের সুনামি ও নির্বাচনী রোডম্যাপে উৎকণ্ঠার কালো ছায়া

prothomalo-bangla_2025-06-15_kuxmea0o_Altaf.avif
আনোয়ার হোসেন
আলতাফ পারভেজ

দেশে হঠাৎ করে সহিংসতার সুনামি শুরু হয়েছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য বিষয় নিয়েও যত্রতত্র রক্ত ঝরছে। প্রতিদিন অন্তত এক দফা দেশের কোথাও বড় ধরনের মারামারি বা রক্তপাতের সংবাদ দেখে ঘুমাতে যাওয়ার সময় পরের ভোর নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হচ্ছে। সিভিল প্রশাসন জনসমাজকে নিরাপত্তার ভরসা দিতে পারছে না। গত বছর সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার পর মব সহিংসতা কিছু কমে এলেও এখন পরিস্থিতি সব নজির ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

তারাগঞ্জে গণপিটুনির আগে হাত জোড় করে এভাবে বাঁচার আকুতি জানান প্রদীপ লাল (বাঁয়ে)। নিজের পরিচয় বলছিলেন রুপলাল (ডানে)

গণ-অভ্যুত্থানের মাস জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে নব-উদ্যমে অস্থিরতা শুরু হয়। মানুষ ভেবেছিল গণ-অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় বছর হবে নির্বাচনমুখী। কিন্তু নির্বাচনের দাবি ও প্রত্যাশা জোরালো হওয়া মাত্র সহিংসতা বাড়তে শুরু করে। গ্রাম-শহরজুড়ে এই দুই বিপরীতমুখী সামাজিক প্রবণতার মধ্যে যোগসূত্রও খুঁজতে শুরু করেছেন মানুষ। নির্বাচন ঠেকাতে পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে কি না, এ প্রশ্নও উঠছে। নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপের খবর ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে সহিংসতাজনিত অনিশ্চয়তা।

রংপুরের তারাগঞ্জে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রদীপ দাস ও রূপলাল দাস নামে দুজন অতি গরিব মানুষকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে ‘উত্তেজিত জনতা’। পুলিশ শত শত উত্তেজিত মানুষের মধ্যে ভয়ে সাহস করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি।

ইদানীং সহিংসতার অনেক ঘটনায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বদলি ও বরখাস্তের ঘটনাও ঘটছে। ফলে এই বাহিনীর পেশাজীবীরাও ব্যাপক মানসিক চাপে পড়েছেন। রাজনৈতিক উত্তেজনা সেই প্রশাসনিক চাপে বাড়তি জ্বালানি জোগাচ্ছে। চলমান সামাজিক অস্থিরতা ও সহিংসতার বড় তরঙ্গ তৈরি হয় গোপালগঞ্জের ১৬ জুলাইয়ের ঘটনার মাধ্যমে। দেশের মানুষ জানত সেখানে এনসিপির জনসভাকে ঘিরে সংঘাত হতে পারে। এ রকম জানাজানির মধ্যেই কয়েকজন মানুষ নিহত হলেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল, কোনো কোনো মহল সচেতনভাবে উত্তেজনা তৈরি করতে চাইছে।

রংপুরের তারাগঞ্জে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রদীপ দাস ও রূপলাল দাস নামে দুজন অতি গরিব মানুষকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে ‘উত্তেজিত জনতা’। পুলিশ শত শত উত্তেজিত মানুষের মধ্যে ভয়ে সাহস করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। আগের মাসে কুমিল্লার মুরাদনগরে তিনজনকে একই কায়দায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ রকম ঘটনা গত কয়েক মাসে বিস্তর। ভবিষ্যতে সেসব কমার কোনো ভরসা দেখছে না মানুষ।

                                              দিনাজপুরের বিরলে ‘জীবন মহল’ বিনোদনকেন্দ্রে হামলা, লুটপাটের একপর্যায়ে মেডিটেশন সেন্টারে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বৃহস্পতিবার বিকেলেছবি

খোদ রাজধানীতে অনুরূপ অনেক ঘটনা ঘটছে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে লাইভ প্রচারের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা আলোচনা সভা ভন্ডুল হলো এবং পরে খোদ আয়োজক ১৬ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হলো। পাশাপাশি সময়ে বিভিন্ন দাবিতে প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের লাগাতার শাহবাগ অবরোধের এক পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে মিছিল শুরু হয় এবং সেই মিছিল শেষ হলো রক্তপাতে। ওই রক্তপাতের বৃত্তান্ত পড়তে পড়তেই জানা গেল, দিনাজপুরের বিরলের মতো শান্ত এলাকায় একটা পার্ক শত শত মানুষের হামলার শিকার হয়েছে। হামলার সচিত্র প্রতিবেদন থেকে দেখা গেল, ঘটনা বেশ প্রস্তুতি নিয়েই হয়েছে এবং পুলিশ সেসব সামলাতে পারেনি।

এ রকম ঘটনার কিছু হচ্ছে তাৎক্ষণিক। একদল মানুষ হঠাৎ লক্ষ্যবস্তুতে হামলে পড়ছে। হামলাকে ন্যায্যতা দিতে নানান অভিযোগ তোলা হচ্ছে, কিছু তার সত্য, কিছু অসত্য। কিন্তু অবলীলায় আইন হাতে তুলে নিয়ে খুনোখুনি বা ভাঙচুর সেরে ফেলা হচ্ছে। থানা, আইন-আদালতের কাছে কেউ আর যেতে চাইছে না। যাওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে বলেও মনে করছে না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুরুল হকছবি: ফেসবুক পেজ থেকে

আবার বেশ প্রস্তুতি নিয়ে, সহিংসতা হবে জেনেও মিছিল-মিটিংয়ের ঘোষণা দিয়ে উত্তেজক অবস্থা তৈরির নজিরও অনেক। দাবিদাওয়া সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পথে আন্দোলন-সংগ্রামের গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে উপস্থাপনের চেয়ে শাহবাগ বা সচিবালয় কিংবা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অবরোধই সফলতার পথ বিবেচিত হচ্ছে ইদানীং। এ রকম সামাজিক ধারণায় কার্যত রাজধানী ঢাকা এখন এক দুঃসহ শহরে পরিণত হয়েছে। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ৯ মে থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ৫৪ বার অবরোধের শিকার হয়েছে। কখনো কখনো এ রকম অবরোধ টানা দীর্ঘ সময় চলেছে।

গণ-অভ্যুত্থানের পর মাসের পর মাস এভাবেই চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক জায়গায় ঘটনার পর হাজির হচ্ছে, কোথাও কোথাও হয়তো নিজেদের সামর্থ্যহীনতা বা ঊর্ধ্বতনদের সিদ্ধান্তহীনতায় পদক্ষেপ নিতে পারছে না। সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকার পরও কেন এ রকম লাগাতার নৈরাজ্য চলছে, সে প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ।

কিন্তু জাতীয় সেনাবাহিনী জনসমাজের চলতি ধাঁচের সহিংসতা মোকাবিলায় প্রশিক্ষিত নয়। তাদের প্রশিক্ষণ হলো জাতীয় প্রতিরক্ষার বিষয়ে। গত এক বছর তাদের ‘মব’ সামলানোর কাজে নিয়োজিত করে রাখার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মূল কাজেও ব্যাপক ছন্দপতন ঘটেছে।

আবার পুলিশ ও যৌথ বাহিনী মব সহিংসতা দমনে সরকার থেকে স্পষ্ট এবং জোরালো দিকনির্দেশনা ও সমর্থন পাচ্ছে কি না, সে বিষয়েও বিভ্রান্তি এবং অনিশ্চয়তা কাটছে না। কখনো দেখা গেছে, একদল শিক্ষার্থী সচিবালয়ে ঢুকে পরীক্ষা ছাড়াই পাসের দাবি আদায় করে নিয়ে ফিরেছেন। যমুনার সামনেও নির্বিঘ্নে অবস্থান করেছেন অনেকে অনেক সময়। আবার কখনো যমুনামুখী সাধারণ মিছিলও লাঠিপেটার শিকার হচ্ছে। কোন মব অনুমোদিত, কোনটায় অনুমোদন নেই, সে বিষয় স্পষ্ট নয়।

গ্র্যাজুয়েট ও ডিপ্লোমাধারী প্রকৌশলীরা পেশাগতভাবে কে কী নামে অভিহিত হবেন, এটা এমন কোনো সমস্যা নয় যে রক্তপাত ও সংঘাত ছাড়া মীমাংসা করা যাবে না। কিন্তু তারপরও আন্দোলন ওই চরিত্র নিল এবং অনেক শিক্ষার্থী আহত হলেন। দেশজুড়ে আত্মবিনাশী এ রকম অবস্থা সর্বগ্রাসী নৈরাজ্যের চেহারা নিচ্ছে কি না, সেই ভয় পাচ্ছে মানুষ। মবপ্রিয় সমাজ জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণেও খোরাক হিসেবে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে কি না, সেই শঙ্কাও সামনে আসছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিগত কয়েক মাসের চেষ্টার পরও জুলাই সনদের বিষয়ে ঐকমত্যে আনতে পারেনি দলগুলোকে। এটাও সমাজে চলতি মব সহিংসতার গতিতে জ্বালানি জোগাচ্ছে। একসময় ধারণা দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় সংস্কারের সেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, সেটাই ‘সনদ’ হিসেবে করণীয় আকারে ভবিষ্যতের সরকারের সামনে তুলে ধরা হবে। জুলাই সনদকে আইনগত রাষ্ট্রনৈতিক ভিত্তিও দেওয়া হবে সবার ঐকমত্যে। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলবে।

এখন দেখা যাচ্ছে, ঐকমত্য কমিশনের পরিসরের বাইরে রাজনৈতিক দলগুলোর তরফ থেকে নতুন নতুন দাবি উঠছে। অনেক দল তাদের দাবিদাওয়া এবং নির্বাচনকে জুলাই সনদের সঙ্গে শর্তযুক্ত করতে চাইছে। তারা নিজেদের অবস্থানের পক্ষে জোট গঠন ও সমাবেশ ক্ষমতা দেখাতেও উদ্যোগী।

ফলে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার কাজ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে এবং তারা একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। সর্বশেষ জাতীয় পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদের কর্মীদের মধ্যকার উত্তেজনা থামাতে যাওয়া পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ভূমিকায় গুরুতর আহত হলেন শেষোক্ত দলের নুরুল হক। এ ঘটনা রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা-বিশ্বাসে বাড়তি চিড় ধরাল। এ ঘটনার জের ধরে গতকালও রাজধানীর কাকরাইলে এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা–ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ রকম চলতে থাকলে রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচনের দাপ্তরিক কাজ কতটা এগোবে এবং জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে গভীর সন্দেহ থেকে যায়।

স্বভাবত, সময়টা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। সমাজকে ভয়মুক্ত করার দায় সরকারের ওপরই বর্তায়। সব ধরনের অস্থিরতা–সহিংসতা নিরসনের একমাত্র পথ জাতীয় নির্বাচন। এ মুহূর্তে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

অনেক বুদ্ধিজীবীও নির্বাচনবিরোধী কথাবার্তার মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতি তাতিয়ে তুলছেন। এ রকম একটা জটিল সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনমুখী লক্ষ্যে কতটা একজোট হয়ে কাজ করতে পারছে, সে বিষয়েও জন–আস্থায় টান ধরেছে।

স্বভাবত, সময়টা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। সমাজকে ভয়মুক্ত করার দায় সরকারের ওপরই বর্তায়। সব ধরনের অস্থিরতা–সহিংসতা নিরসনের একমাত্র পথ জাতীয় নির্বাচন। এ মুহূর্তে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

  • আলতাফ পারভেজ, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top