মরিচ ও লন্ঠন জবার আখ্যান

prothomalo-bangla_2025-09-17_2i2rqojl_17092025-cm-16.avif
আনোয়ার হোসেন

সরকারি আনন্দমোহন কলেজ আমার একসময়ের কর্মস্থল। গত বছরের শেষ দিকে একদিন গেলাম ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপীঠে। কলেজ ভবনের আঙিনাতেই প্রাণিবিদ্যা ল্যাবরেটরির সামনে পেলাম মরিচ জবার দেখা। পরে লন্ঠন জবা পেলাম উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বাগানে।

মরিচ জবা তো নয়, যেন ভাঁজ করে রাখা একেকটি ছাতা। গাছজুড়ে ভাঁজ করে রাখা লাল ছাতার মতো ফুলের সমাহার। ছবি তুলে ফেললাম দ্রুত। ছোটবেলায় বাড়ির বাগানে ফোটা এই ফুল নিয়ে খেলেছি অনেক। সেই স্মৃতি মনে পড়ে গেল।

গুল্মজাতীয় একটি উদ্ভিদ মরিচ জবা। ফুল দেখতে পাকা মরিচের মতো হওয়ায় এর এমন নাম। মরিচ জবার গাছ সাধারণত ১ থেকে ৫ মিটার উঁচু হয়। অনেকে বাড়িতে বেড়া দেওয়ার জন্য এই গাছ লাগায়। শোভাবর্ধনেও এই ফুল গাছ বাড়ির চারপাশে রোপণ করা হয়। তবে আমাদের দেশে এখন আর এই ফুলগাছ অতটা চোখে পড়ে না।

মরিচ জবার বৈজ্ঞানিক নাম ম্যালভাভিসকাস আরবোরিয়াস। এটি ম্যালভেইসি পরিবারের একটি উদ্ভিদ। পাতা সরল, একান্তর, বল্লমাকার, তিন লোববিশিষ্ট। কখনো কখনো লোববিহীনও হয়ে থাকে। পাতার কিনারাগুলো খাঁজকাটা থাকে। লম্বায় প্রায় ৯ সেন্টিমিটার, চওড়া ৬ সেন্টিমিটারের মতো। ফুল একক বা পাতার কক্ষে একত্রে কয়েকটি জন্মে। ফুল উজ্জ্বল লাল রঙের, ফানেলাকার কিন্তু মুখের দিকে সরু। বৃতি সবুজ রঙের। প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে, বেশি ফোটে শরতে এবং শীতের শুরুতে।

মরিচ জবার আদি নিবাস মেক্সিকো, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা। এর অনেক ইংরেজি নাম আছে—ওয়াক্স ম্যালো, টার্কস ক্যাপ (ম্যালো), টার্কস টারবান, স্লিপিং হিবিস্কাস, মানজানিলা, মানজানিটা (ডি পোলো), লেডিস টিয়ারড্রপ উল্লেখযোগ্য। ফুল পুরোপুরি খোলে না। প্রজাপতি ও হামিংবার্ডকে আকর্ষণ করে এই ফুল। ফুলে মধু থাকে। ডালপালা ও পাতা অবিকল জবার মতোই। ঝোপালো গাছ। ডালপালা এলানো থাকে। ফুল ঝুলন্ত। আকৃতি মরিচের মতো। পাঁচ থেকে ছয় সেন্টিমিটার লম্বা হয়। গাঢ় লাল ও সাদা—দুই ধরনের ফুল পাওয়া যায়। শীতের প্রথম দিকে যখন অন্যান্য ফুল পাওয়া যায় না, তখন মরিচ জবা ফোটে। তাই এর চাহিদাও থাকে বেশি।

পূজার ফুল হিসেবে ও মালা তৈরির জন্য এ ফুলের বেশ কদর রয়েছে। ফুল বেশ কিছুদিন গাছে টিকে থাকতে পারে। একই সঙ্গে অনেক ফুল ফোটে, তাই খুব সহজেই এরা নজর কাড়তে পারে। এই গাছ দ্রুতবর্ধনশীল। বৃদ্ধির জন্য রোদের দরকার হয়।

উজ্জ্বল লাল ফুলের জন্য জনপ্রিয় মরিচ জবা। ফুল সম্পূর্ণভাবে ফুটলে পাপড়িগুলো পুংকেশরের চারপাশ আবৃত করে রাখে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে ভালোভাবে জন্মায়। বীজ বা কাণ্ড কেটে সহজেই বংশবিস্তার করা যায়।

মরিচ জবার ফুল, পাপড়ি ও গাছের ছালে রয়েছে ঔষধি গুণ। চোখ ওঠা, সর্দি ও কাশি, চুলের বৃদ্ধি, হাতের তালুতে চামড়া ওঠা ইত্যাদি রোগে কাজে লাগে এই ফুল।

আনন্দমোহন কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বাগানে লন্ঠন জবা ফুল
আনন্দমোহন কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বাগানে লন্ঠন জবা ফুলছবি

ফুল নয় যেন লন্ঠন

দেখতে লন্ঠনের মতো বলে জবার একটি ধরনের নাম লন্ঠন জবা। এর বৈজ্ঞানিক নাম ক্যালিঅ্যান্থি পিকটা। এটিও মরিচ জবার মতো ম্যালভেইসি পরিবারের একটি উদ্ভিদ। এটি ইংরেজিতে চাঢনিজ ল্যান্টার্ন, রেড ভেইন ফ্লাওয়ারিং ম্যাপল, রেড ভেইন ইন্ডিয়ান ম্যালো, পেইন্টেড ম্যালো ইত্যাদি নামে পরিচিত।

ফুলের পাপড়ি একটি আরেকটিকে ঢেকে রাখে। লন্ঠনের মতো ফুল লম্বা। ডালপালা থেকে ফুল নিচের দিকে ঝুলে থাকে। গাছ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে লম্বা ও পাতলা হয়ে যায়। পাতা আকর্ষণীয়। লাল ছাড়া সাদা ও হলুদ হতে পারে ফুল। আর লাল শিরা থাকে ফুলে।

লন্ঠন জবার আদি নিবাস লাতিন আমেরিকা। ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়েতে বেশি পাওয়া যায়। আমাদের দেশেও এই ফুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অনেক আগে থেকেই। অল্প পরিচর্যাতেই ভালো থাকে এই ফুল।

গাছের শাখা থেকে যখন লন্ঠনের মতো ফুল ঝুলে থাকে, তখন খুব সুন্দর দেখায়। মণিপুরিদের কাছে এই ফুল পুতুল নামে পরিচিত।

  • চয়ন বিকাশ ভদ্র: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top