ট্রেলারে রোমাঞ্চের আভাস ছিল, কিন্তু নির্মাতার প্রথম কাজ কেমন হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তবে অনন্য প্রতীক চৌধুরীর প্রথম পরিচালনা দেখে বোঝার উপায় ছিল না মোটেও। যাঁরা ভিক্ষা করেন, তাঁদের সাধারণত পুরোনো নোটই ভিক্ষা দেওয়া হয়। তবে গল্পটা নতুন নোট নিয়ে। ভিক্ষুককে যখন নতুন নোট দেওয়া হলো, তখন থেকেই সিনেমাটি মোড় নিল এক থ্রিলার গল্পে। ভিক্ষা করাকে কেন্দ্র করে যে এমন গল্প জন্ম নিতে পারে কে জানত! কথা হচ্ছিল সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আই স্ক্রিনে মুক্তি পাওয়া ওয়েব ফিল্ম ‘নয়া নোট’ নিয়ে। অনন্য প্রতীক চৌধুরী পরিচালিত এই ওয়েব ফিল্ম মুক্তি পেয়েছে ১২ সেপ্টেম্বর।
একনজরে
ওয়েব ফিল্ম: ‘নয়া নোট’
ধরন: ড্রামা-থ্রিলার
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: অনন্য প্রতীক চৌধুরী
স্ট্রিমিং: আই স্ক্রিন
রানটাইম: ১ ঘণ্টা ১৩ মিনিট
অভিনয়: নাসির উদ্দিন খান, পার্থ শেখ, নওবা তাহিয়া হোসেন, দীপা খন্দকার, এ কে আজাদ সেতু, সমু চৌধুরী
শহরের শিক্ষিত তরুণ রেহান। ছোটবেলা কেটেছে অভাবে। পঙ্গু বাবার কাছে বড় হয় সে। ছেলেকে বড় করতে গিয়ে বাবাকে অনেকের কাছে হাত পাততে হয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে বাবার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলতেন, ‘আমি সারা জীবন হাঁটতে পারি নাই, কিন্তু তুই দৌড়াবি।’ বাবাকে দেওয়া কথা রাখতে নিজের চেষ্টায় চাকরি জোগাড় করে রেহান। কারও ওপর নির্ভর করে চাকরি পেতে চায়নি সে।
রাস্তার পাশে চা খেতে গিয়ে এক ভিক্ষুকের সঙ্গে পরিচয় হয় রেহানের। তাকে দেখে নিজের বাবার কথা মনে পড়ে; চাচা বলে তাকে ডাকে তাঁকে।

ডেকে চা খাওয়ায়, অফিসের গল্প শোনায়, পরামর্শ চায়। আর প্রতিবারই যাওয়ার সময় তাঁর হাতে গুঁজে দেয় সাধ্যমতো টাকা। একদিন চকচকে নতুন নোট দেয় সে চাচাকে। নতুন নোট দেখে বদলে যায় সেই ভিক্ষুকের চেহারা। কেন চকচকে হয়ে ওঠে তাঁর মুখ? তারপর ধীরে ধীরে বের হতে থাকে এক অন্ধকার জগতের গল্প। এরপর কী হয়, জানতে গেলে দেখতে হবে ‘নয়া নোট’।
এই ওয়েব সিনেমায় ভিক্ষুকের চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন নাসির উদ্দিন খান। ভিক্ষুক হিসেবে তিনি যেমন অনবদ্য ছিলেন, তেমনি ভোল পাল্টানো রূপেও ভালো ছিলেন। রেহান চরিত্রে পার্থ শেখ ভালো অভিনয় করেছেন। শেষ দৃশ্য পর্যন্ত তিনি নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। নওবা তাহিয়া হোসেনের আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। দীপা খন্দকার যেন বেশ সাদামাটা; তাঁর অবশ্য করার ছিল কমই। কারণ, তাঁর চরিত্রটিই ঠিকঠাক লেখা হয়নি। পর্দায় কম উপস্থিতি থাকলেও এ কে আজাদ সেতু ভালো করেছেন।

ওয়েব ফিল্মটি দৈর্ঘ্যে ছোট। সিনেমার একটা নীলাভ টাচ রয়েছে, যা চোখে আরাম দেয়। সুমন হোসেনের সিনেমাটোগ্রাফিও মন্দ না। তবে আবহসংগীত নিয়ে আরও কাজ করার প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে গল্প যখন থ্রিলারে মোড় নেয়, তখনকার আবহসংগীত সিনেমার মেজাজের সঙ্গে অনেক সময়ই মানায়নি। তবে এই ওয়েব ফিল্মের গান ‘আমিও মানুষ’ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। পরিচালক এখানে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। গানটি গেয়েছে ব্যান্ড ‘নাইভ’। লিখেছেন নির্মাতা নিজেই।

‘নয়া নোট’-এর আরেকটি ইতিবাচক দিক সংলাপ। ‘দুই দুগুণে তিন’, ‘মানুষ তো মাগনা মাগনা ভিক্ষা দেয় না, মানুষ ভিক্ষা দেয় তাদের ভালো কিছু হইব এই আশায়’—সংলাপগুলো ফিল্ম শেষ হওয়ার পরও কানে বাজতে থাকে। তবে সিনেমার চরিত্রগুলোকে আরও ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা যেত। জাহাঙ্গীরের চরিত্র আরেকটু কঠোর হলে তা বেশি মানানসই লাগত। এই চরিত্রে তাঁর প্রভাব এবং আধিপত্য ফুটে উঠেছে খুব অল্পই। চাইলে তাঁর দ্বিতীয় সত্তাটা আরেকটু সবিস্তার দেখানো যেত। স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর একটি ‘অতীত’ থাকলেও তাদের সম্পর্ক দেখে তা বোঝা যায় না। মূলকথা, নির্মাতা ব্যাক স্টোরির দিকে একেবারেই মনোযোগ দেননি।

দায়সারাভাবে কিছু ফ্ল্যাশব্যাক দেখিয়ে কাজ সেরেছেন। সিনেমায় উঠে এসেছে শহরের সিন্ডিকেটের কথা কিন্তু একটি দৃশ্যে কয়েকটি সংলাপের মাধ্যমেই সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন নির্মাতা। অফিসের নারী কর্মী মানেই বসের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক, ক্লিশে এ ব্যাপারটিও দেখতে বিরক্ত লাগে।
রেহানের সঙ্গে তাঁর প্রেমিকার কথোপকথন অনেকটাই আরোপিত মনে হয়; কয়েকটি দৃশ্যে সম্পাদনার খামতিও চোখে পড়ার মতো।

ওটিটিতে ফি সপ্তাহে আসা ভূরি ভূরি থ্রিলারের বাইরে ভিন্নধর্মী গল্পের সিনেমা ‘নয়া নোট’। গল্পে যেমন নতুনত্ব ছিল, তেমনি ছিল এর উপস্থাপনা। দুজন আলাদা ব্যক্তির ছোটবেলা এবং বড়বেলার গল্প দেখানো হলেও তা সাংঘর্ষিক নয়, গল্প বোঝা যায় সহজেই। থ্রিলার গল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ সমাপ্তি। কিন্তু এ সিনেমার শেষটা বেশ অনুমানযোগ্য। তবু নির্মাতা শেষ পর্যন্ত চমক রাখার যে একটা চেষ্টা করেছেন, তা এই ওয়েবফিল্ম দেখলেই বুঝতে পারবেন।