prothomalo-bangla_2023-10_c786e474-f3f1-471f-82d8-01499a5372ba_Untitled_3.avif
আনোয়ার হোসেন

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার যুবক রহমান খলিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করেন ২০১৮ সালে। পরিশ্রম করে বিসিএস পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। ৪১তম বিসিএসে নন-ক্যাডার পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হলেও এখনো তিনি কোনো চাকরি পাননি। ৪৩তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে মাত্র ৬৪২ জনকে সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)।

তাঁদের একজন রহমান খলিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি, কিন্তু চাকরি পাচ্ছি না। অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে এখন ৪ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি পদ শূন্য।’

বাংলাদেশে সরকারি চাকরির সবচেয়ে বড় নিয়োগ পরীক্ষা হলো বিসিএস। মেধা যাচাইয়ের তিন ধাপের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অনেকে ক্যাডার পদে যোগ দেন। কিন্তু হাজারো প্রার্থী ক্যাডার পদে সুযোগ পান না। তাঁদের মধ্য থেকেই নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নন-ক্যাডার নিয়োগপ্রক্রিয়া নানা জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছে। এতে একদিকে চাকরিপ্রত্যাশীদের হতাশা বাড়ছে, অন্যদিকে সরকারি সেবাদান ব্যবস্থার কার্যকারিতা ব্যাহত হচ্ছে।

নন-ক্যাডার নিয়োগের সূচনা

পিএসসি ৩১তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করে। তবে ৩৪তম বিসিএস থেকে উল্লেখযোগ্য হারে নিয়োগ দেওয়া হয়। সাধারণত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির (দশম গ্রেড পর্যন্ত) পদে নন-ক্যাডার নিয়োগ হয়ে থাকে। ২০১৬ সাল থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগও এর আওতায় আসে। আগে এ পদটি ছিল ১১/১২ গ্রেডে। হাইকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে ২০১৯ সালে এটি উন্নীত হয় দশম গ্রেডে।

পিএসসির সাবেক সদস্য সমর পাল বলেন, ‘আমি দায়িত্বে থাকাকালে চেষ্টা ছিল নন-ক্যাডার থেকে যত বেশি সম্ভব নিয়োগ দেওয়ার। সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সরাসরি নিয়োগ কমিয়ে নন-ক্যাডার নিয়োগ বাড়ানো হলে একদিকে খরচ কমবে, নিয়োগপ্রক্রিয়া সহজ হবে এবং যোগ্য প্রার্থীরা সুযোগ পাবে।’

আরও পড়ুন

মেট্রোরেলে নতুন চাকরি, স্নাতকে আবেদন

মেট্রোরেলে নতুন চাকরি, স্নাতকে আবেদন

নন-ক্যাডার নিয়োগে সংকট কেন

সরকারি কর্ম কমিশন ৪১তম বিসিএসে নন-ক্যাডার থেকে ৯ম, ১০ম, ১১তম ও ১২তম গ্রেডে মোট ৩ হাজার ১৬৪ জনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল। ৪০তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থী ছিলেন ৪ হাজার ৩২২ জন। কিন্তু ৪৩তম বিসিএসে সংখ্যা নেমে আসে মাত্র ৬৪২–এ। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে সংকট।

পিএসসি ও চাকরিপ্রার্থীদের মতে, এর নেপথ্যে রয়েছে নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা ২০২৩। ওই বিধি অনুযায়ী, ৪৩তম বিসিএসে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের ফল একসঙ্গে প্রকাশ করা হয়। অথচ ৪০ ও ৪১তম বিসিএসে প্রথমে ক্যাডার পদের ফল প্রকাশ করা হয়েছিল। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী নন-ক্যাডারের ফল দেওয়া হয়। এতে বেশি প্রার্থী চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন।

নন-ক্যাডারে কমসংখ্যক প্রার্থী সুপারিশ পাওয়ায় আন্দোলনে নেমেছেন চাকরিপ্রার্থীরা। ‘বিসিএস চাকরিপ্রত্যাশী প্রার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে তাঁরা গত ২৬ আগস্ট থেকে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন। আন্দোলনকারীরা বলছেন, নন-ক্যাডার বিধিমালা ২০২৩ দ্রুত সংস্কার করতে হবে। শাহ মুস্তাহিদুর রহমান নামের এক আন্দোলনকারী বলেন, ‘আগে ধাপে ধাপে নন-ক্যাডার ফল প্রকাশিত হতো। এতে অনেকেই চাকরির সুযোগ পেতেন। এবার একসঙ্গে ফল প্রকাশ করে মাত্র ৬৪২ জনকে সুপারিশ করা হয়েছে।’

জনপ্রশাসনে শূন্য পদ বিপুল

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্ট্যাটিসটিকস অব পাবলিক সার্ভেন্টস ২০২৪ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি দপ্তরে মোট শূন্য পদ রয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ২২০টি। অনুমোদিত মোট পদের ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ শূন্য।

এসব শূন্য পদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০তম গ্রেডে—৭৯ হাজার ১৫১টি। এরপর ১০ম গ্রেডে শূন্য পদ ৭১ হাজার ৭৯৭টি। অধিকাংশ শূন্য পদ রয়েছে বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশনে। প্রথম থেকে ১২তম গ্রেড পর্যন্ত গেজেটেড পদে নিয়োগ দেয় পিএসসি। ১৩ থেকে ২০তম গ্রেডের নিয়োগ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।

আরও পড়ুন

এ সপ্তাহে (২৯ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর) সেরা সরকারি চাকরি, পদ ৬৪২০

এ সপ্তাহে (২৯ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর) সেরা সরকারি চাকরি, পদ ৬৪২০

যোগ্য প্রার্থীর সংকটও আছে

শূন্য পদ যতই থাকুক, আরেকটি বাস্তবতা হলো যোগ্য প্রার্থীর অভাব। ৪৩তম বিসিএসে আবেদন করেছিলেন ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০ জন। এর মধ্যে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ২২৯ জন। লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন ৯ হাজার ৮৪১ জন। শেষ পর্যন্ত সরকারি চাকরির জন্য সুপারিশ পান মাত্র ২ হাজার ৮০৫ জন।

পিএসসি সূত্রে জানা যায়, একটি বিসিএসে আবেদনকারীর বিপরীতে সাধারণত শূন্য দশমিক ৪৫ থেকে শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, ৩৭তম বিসিএসে এই হার ছিল শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ, ৩৮তম বিসিএসে শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ, ৪০তম বিসিএসে শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ, ৪১তম বিসিএসে শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ, ৪৩তম বিসিএসে শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং ৪৪তম বিসিএসে শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ।

আরও পড়ুন

ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনে চাকরি, ৫ পদে নেবে ৪৭ জন

ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনে চাকরি, ৫ পদে নেবে ৪৭ জন

পিএসসির অবস্থান

নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা ২০২৩ সংশোধনের বিষয়ে পিএসসি নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। এ-সংক্রান্ত ফাইল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি। পিএসসির চেয়ারম্যান মোবাশ্বের মোনেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই যত বেশি সম্ভব নন-ক্যাডার প্রার্থীকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দিতে। এতে সময় ও খরচ—দুটোই কমবে, দুর্নীতিও কমবে। তবে এর জন্য সরকারের আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় জরুরি। বিধি সংশোধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আমরা আশা করছি, দ্রুত সমাধান হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top