পাহাড় ও ছোট ছোট টিলা যেন ঢেউ তোলে মাটির বুকজুড়ে। চা-বাগানের সারি সারি গাছ বাতাসে দোলে ছন্দে ছন্দে। গহিন বনে ছায়া ফেলে শতবর্ষী বৃক্ষ, ডাক পাঠায় অচেনা পাখি। হাওরের জলে খেলে সূর্য।
ইতিহাস, প্রকৃতি আর নীরব সৌন্দর্যের মিলনে এক অন্য রকম অনুভবের নাম হবিগঞ্জ। হাওরসমৃদ্ধ এই জেলায় আছে ঐতিহাসিক সাগরদিঘি, উচাইল শংকরপাশা শাহী মসজিদ ও বিথঙ্গল আখড়ার মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা। পাহাড়ি বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে ছুটে আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ।
পাহাড়ি বন রেমা-কালেঙ্গা
রেমা-কালেঙ্গার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখা মিলবে মায়া হরিণ, মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, মেছো বাঘ, বন্য শূকর, গন্ধগোকুল, বেজি ও শজারুর সঙ্গে। এ রকম ৩৭ প্রজাতির বন্য প্রাণী ও স্তন্যপায়ী আছে এ বনে। সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি ছাড়া আছে ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম।
দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক পাহাড়ি বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। প্রায় ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এ বনভূমি অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃত। এর পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬৭ মিটার।
এ বন্য প্রাণী-অভয়াশ্রমে আছে আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও তিন ঘণ্টার তিনটি ট্রেইল বা পথ। প্রতিটি ছবির মতো সুন্দর আর সাজানো। এ অভয়ারণ্যের ভেতর আরও আছে একটি সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। টাওয়ারটির মাথা বনের উঁচু উঁচু গাছের উচ্চতা ভেদ করে আকাশে উঁকি দিয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় বনের ভেতরের দূর-দূরান্তের সবুজ দৃশ্য। টাওয়ারের ঠিক নিচেই আছে আঁকাবাঁকা একটি লেক।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনধারাও দেখা যেতে পারে এখানে। ত্রিপুরা, সাঁওতাল, তেলুগু ও উড়ং সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের বসবাস আছে এ বনের ভেতরেই। কালেঙ্গায় থাকার জন্য আছে বন বিভাগের বিশ্রামাগার। সেখানে অবস্থান করতে হলে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অনুমোদন লাগবে।
সাগরদিঘি
স্বচ্ছ জলে ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর সূর্যের আলো নেচে বেড়ায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন ছোট ছোট প্রদীপ ভাসছে। সবুজ বেষ্টনীর মাঝখানে বিশাল দিঘিটি দেখতে অনেকটা সাগরের মতো। যে কারণে সবাই সাগরদিঘি বলে। এ দিঘির পাড়ে বসেই পল্লিকবি জসীমউদ্দীন ‘রাণী কমলাবতীর দিঘি’ নামের কবিতাটি রচনা করেছিলেন।
বানিয়াচং উপজেলা সদরে অবস্থিত দিঘিটি জেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দিঘিটি দেখতে প্রতিদিন দেশের নানা জায়গা থেকে অনেকে বেড়াতে আসেন। দিঘিটি আয়তনের দিক থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাধার হিসেবে স্বীকৃত। এর আয়তন ৬৬ একর। হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে যেকোনো পরিবহনে বানিয়াচং সাগরদিঘিতে যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিট।

উচাইল শংকরপাশা শাহি মসজিদ
৫০৫ বছরের পুরোনো উচাইল শংকরপাশা শাহি মসজিদটি চুন-সুরকি আর লাল ইট দিয়ে তৈরি। মসজিদের নকশা ও ইটের বৈচিত্র্যময় গাঁথুনি দৃষ্টি কাড়ে সবার। যে কারণে হবিগঞ্জে কেউ বেড়াতে এলেই মসজিদটির স্থাপত্য নান্দনিকতা দেখতে আসেন। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রাজিউড়া ইউনিয়নের উচাইল গ্রামে এ মসজিদের অবস্থান। জেলা সদর থেকে মসজিদের দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার।
দেশের পুরাকীর্তিগুলোর যে গড়পড়তা বিধ্বস্ত চেহারা, সে তুলনায় উচাইল শংকরপাশা মসজিদের অবস্থা যথেষ্ট ভালো। প্রাঙ্গণটি নিরিবিলি এবং খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মসজিদের চারপাশ সবুজ গাছগাছালিতে ঢাকা। পাশাপাশি খেজুরগাছের সারিতে ঘেরা চত্বরটি পুরো মসজিদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। গম্বুজওয়ালা প্রাচীন স্থাপত্যটিকে বেশ মনোরম দেখায় এ প্রাকৃতিক পরিবেশে।
বিথঙ্গলের আখড়া
বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম তীর্থস্থান বিথঙ্গলের আখড়া। এটি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার প্রত্যন্ত ভাটি এলাকা বিথঙ্গল গ্রামে অবস্থিত। এর প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামী। তিনি উপমহাদেশের বিভিন্ন তীর্থস্থান সফর শেষে ষোড়শ শতাব্দীতে বিথঙ্গল গ্রামে আখড়াটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ আখড়ায় ১২০ জন বৈষ্ণবের জন্য ১২০টি কক্ষ আছে। আখড়ায় বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করা হয়। এ আখড়ায় দর্শনীয় বিষয়টি হচ্ছে ২৫ মণ ওজনের শ্বেতপাথরের চৌকি, পিতলের তৈরি সিংহাসন, সুসজ্জিত রথ, রৌপ্য পাত্র ও একটি সোনার মুকুট।
হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে বিথঙ্গলে আখড়ায় ভ্রমণের সময় বর্ষা মৌসুমে। হাওরে পানি যখন ঢেউ খেলে, তখন নৌকায় বেড়ানোর জন্য অতি সহজ এ তীর্থস্থান। সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান
দেশে যে ১০টি জাতীয় উদ্যান আছে, তার মধ্যে সাতছড়ি অন্যতম। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর প্রাকৃতিক এ বন চুনারুঘাট উপজেলার রঘুনন্দন পাহাড়ে ৬০০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতর সাতটি ছড়া বা ঝরনা আছে। এখান থেকে এর নামকরণ করা হয় সাতছড়ি।
এই জাতীয় উদ্যানকে ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট বা মিশ্র চির সবুজ এবং পাতাঝরা বন বলা হয়ে থাকে। উদ্যানের আশপাশে ৯টি চা-বাগান আছে। উদ্যানের পশ্চিম দিকে সাতছড়ি চা-বাগান এবং পূর্ব দিকে চাকলাপুঞ্জি চা-বাগান অবস্থিত। উদ্যানের অভ্যন্তরভাগে টিপরাপাড়ায় ২৪টি পরিবার বসবাস করে।
জীববৈচিত্র্যময় এ উদ্যানে ১৯৭ প্রজাতির জীবজন্তু আছে। এর মধ্যে প্রায় ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির উভচর। আরও আছে প্রায় ১৫০-২০০ প্রজাতির পাখি। এটি বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং পাখিদের একটি অভয়াশ্রম। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে আছে ২০০ প্রজাতির বেশি গাছপালা।
হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে সাতছড়ির দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটার। শায়েস্তাগঞ্জ সদর থেকে যাতায়াত খুবই সহজ, সময় লাগে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। শ্রীমঙ্গল থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এ উদ্যান। ঢাকা থেকে যাঁরা আসতে চান, তাঁদের ১৩০ কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে আসতে হবে এখানে।
চা–বাগানসহ আছে আরও কিছু
চুনারুঘাট, মাধবপুর, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলার কিছু অংশে আছে ২৪টি চা-বাগান। চা-বাগানগুলোর নৈসর্গিক দৃশ্য সহজেই দর্শনার্থীদের মোহিত করে। শাহজিবাজার ও বাহুবলের রুপাই ছড়ায় আছে দুটি বড় রাবার বাগান, শাহজিবাজার ও রশিদপুরে আছে তিনটি গ্যাস ফিল্ড। নবীগঞ্জ উপজেলার বিয়িনায় আছে দেশের অন্যতম গ্যাস ফিল্ড ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এ ছাড়া মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ভেতরে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বুলেট আকৃতির স্মৃতিসৌধ।

তেলিয়াপাড়ার বাংলো
পুরো দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা, এস, কে ফোর্স ও জেড ফোর্স গঠন, স্বাধীনতা যুদ্ধের নকশা প্রণয়ন ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ—সবই এসেছিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা-বাগান ব্যবস্থাপকের বাংলোতে। জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তেলিয়াপাড়া চা-বাগান।
পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধের সাক্ষী বাংলোটি। ঐতিহাসিক স্থাপনাটি আজও তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকদের বাংলো হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অবশ্য ২, ৩ ও ৪ নম্বর সেক্টরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বাংলোর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে নির্মিত হয়েছে তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ। বুলেটের আকৃতিতে তৈরি এই স্মৃতিসৌধের প্রবেশের পথে আছে দুটি ফলক। তাতে অঙ্কিত আছে কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার পঙ্ক্তিমালা।
চা-বাগানের সবুজ বেষ্টনীতে স্মৃতিসৌধ ছাড়াও আছে একটি প্রাকৃতিক হ্রদ। লাল শাপলা ফোটা এই হ্রদ বর্ষাকালে অপরূপ হয়ে ওঠে। স্মৃতিসৌধ থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই ঐতিহাসিক বাংলোটি।
ঢাকা থেকে হবিগঞ্জে যাত্রার উপায়
ঢাকা থেকে হবিগঞ্জে আসতে চাইলে ভ্রমণকারীরা সড়কপথ ও রেলপথ—দুটি মাধ্যমেই যাত্রা করতে পারেন। বাসে যাত্রীপ্রতি নন–এসিতে ৪৫০-৫৫০ টাকা, এসিতে ৭০০-৯০০ টাকা ভাড়া।
হবিগঞ্জে সরাসরি কোনো রেলস্টেশন নেই। ভ্রমণকারীরা ঢাকা থেকে ট্রেনে শায়েস্তাগঞ্জ (হবিগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ১০ কিমি) পর্যন্ত আসতে পারেন। যাত্রীপ্রতি ভাড়া শোভন চেয়ার ৩০০-৩৫০ টাকা, এসি সিট ৭০০-৮০০ টাকা, এসি স্নিগ্ধা ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে অটোরিকশা ও লোকাল বাসে সহজেই ৩০-৫০ টাকা ভাড়ায় হবিগঞ্জ যাওয়া যায়।